০২:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ১২ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই চব্বিশের উপকথা

২১ জুলাই, রবিবার, ২০২৪। সারাদেশ কোটা আন্দলনের ফলশ্রুতিতে কারফিউ জারী করে সরকার। নির্বাহী আদেশে সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয়। সুপ্রীম কোর্ট তার উভয় বিভাগে জরুরী কার্যক্রম চালু রাখার কথা বললেও বিচারিক আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। কোটার বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল শুনানীর জন্য সকাল ৯ টার পরিবর্তে সকাল ১০ টায় বসে মহামান্য আপীল বিভাগ। যেহেতু, অন্যান্য মামলা কারফিউ-এর মধ্যে হবেনা বলে সকালে কোর্টে যাওয়ার কথা থাকলেও বাসাতেই থেকে যাই। দেরিতে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে টিভিতে দেশের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। প্রায় সকল টিভি চ্যানেলে কারফিউ আর আদালতের খবর প্রচার করছে। ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে সরকার। রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধু বান্ধব অনেকে ফোন করে আদালতের রায় সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। ছাত্রদলসহ যে সকল রাজনৈতিক সহকার্মী বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছে, তাদের সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। এসময়ে জানতে পারলাম, আপীল বিভাগ হাইকোর্টের রায়কে সরাসরি বাতিল করে ৭% কোঠা রেখে বাকি ৯৩% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের আদেশ প্রদান করে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী হাইকোর্টের রায়ে কোন ভুল ক্রটি থাকলে প্রাথমিক শুনানী শেষে আপিল বিভাগ উক্ত লিভ-টু-আপিলে লিভ প্রদান করে প্রয়োজনীয় পেপারবুক প্রস্তুত পূর্বক শুনানী গ্রহন করে রায় প্রদান করে থাকেন এবং এক্ষেত্রে আদালত মনে করলে হাই কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নজীরবিহীন এই রায়ে আদালত সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ  এর সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে আন্দলনরত শিক্ষার্থীদের দাবীকে আইনে গ্রহনযোগ্য বিবেচনায় নিয়ে ৭ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় প্রদান করে কোটা প্রথা সংস্কারের জন্য সরকারকে নির্দেশ প্রদান করেন। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোঠা ৫% ও অন্যান্য কোটা ২% সংরক্ষণ করে সরকারকে ৩ (তিন) মাসের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারী করতে বলা হয়। বাস্তবে এই রায় ছিল তৎকালীন ভোটারবিহীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার একটি বিচারিক প্রয়াস, কেননা আন্দোলনের পূর্বে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়কে স্থগিত করেনি। যাইহোক দিনভর বাসায় থেকে বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জায়গার পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করি। আমার ছেলে সিমাক শেখ বাসায় থাকলে কম্পিউটার-এ বসে থাকতে ভালবাসে, সে চিন্তা থেকে ওকে বললাম বাবা চল মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ি। বাসার গেটের বাইরে এসে দেখি চারটি মটর সাইকেল নিয়ে ৭/৮ জন পুলিশ দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে নাম ও গন্তব্য জিজ্ঞাসা করল। আমি তাৎক্ষনিক ভাবে উত্তর দিলাম, মাগরিবের নামাজের জন্য বেরিয়েছি। এর পর দুইজন আমাকে টেনে মটর সাইকেলে উঠায়, সামনে একজন ও পিছনে একজন, আর আমাকে মাঝখানে বসিয়ে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে আসে। ওসি পারভেজ ইসলাম (পিপিএম, বার, বিপি: ৮২০৪১০০৩৪৭) প্রথমে আমাকে বসতে দেয়, আর সে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা উঠিয়ে দিয়ে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। একপর্যায়ে আমার গ্রেফতার অভিযানের দুই জন S.I এসে আমাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই শরীরিক নির্যাতন করে ও ক্রস ফায়ারে নিয়ে যেতে চায়। একপর্যায়ে ওসি পারভেজ ইসলাম আমার মোবাইল ব্যবহার করে বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য মনির ফরাজিকে কল করে এবং পরে তাকে ধানমন্ডি ৯/এ থেকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে, আমি দেখতে পাই পুলিশের দুই জন S.I মনির ফরাজি কে ওসির রুমে নিয়ে আসে, তখন তার দুই হাত পেছনের দিকে হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিল, কিছুক্ষন পর তাকে ওসির রুম থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তীতে আমি তাকে হাজতের গারদখানায় দেখতে পাই। এরপর আসে দীর্ঘ দেহী আদনান নামের এক লোক, পরে জানতে পারি সে পুলিশের দালাল (Tout)। সে আমাকে বিভিন্ন ভয় ভীতি দেখায় ও মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে। এক পর্যায়ে ওসি পারভেজ ফোন দিয়ে আমার স্ত্রী (লিমা) কে থানায় আসতে বলে। লিমা আসার পর আদনান ও পারভেজ মিলে আমার কাছে টাকা দাবী করে এবং সাথে আসা আমার A-Level পড়ুয়া মেয়েকে কোটা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কথা বলে গ্রেফতারের ভয় দেখায়। তাৎক্ষনিক লিমা পারভেজকে ২ (দুই) লক্ষ টাকা দিলে সে কিছুটা ভদ্র আচরণ শুরু করে। তার সহযোগী আমাকে চা বানিয়ে দেয় ও বসতে দেয়। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে, আমাকে তিনটি মামলার যে কোন একটিতে গ্রেফতার দেখানোর প্রস্তাব দেয়।

মামলাগুলি হল-

(১)          স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ী ভাংচুর মামলা

(২)         যাত্রাবাড়ী পুলিশ হত্যা মামলা ও

(৩)         শংকরে গাড়ী ভাংচুর ও ককটেল বিস্ফোরন মামলা

আমি ওসি পারভেজ কে বললাম “আমার কোন চয়েজ নেই, আমি কোনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত না”আপনার বিবেচনা। যাই হোক রাত ১২ টার পর আমাকে লক-আপে ঢুকিয়ে দেয়। সেন্ট্রি এসে আমাকে একটি পানির বোতল দেয়, মাথায় দিয়ে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু সারারাত পুলিশ সদস্যরা গারদের সামনে এসে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে যার ফলে নির্ঘুম রাত পার করি। সকালে প্রিজন ভ্যানে প্রথমে শাহবাগ থানায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে নিয়ে আসে। সেখানে এসে দেখি কারফিউ উপেক্ষা করে আমার ছোট ভাই জাবির সহ আমার চেম্বারের সকল সহকর্মী ও অসংখ্য গুণাগ্রাহী উপস্থিত। আদালতে এসে জানতে পারলাম আমাকে ধানমন্ডির শংকরে গাড়ী পোড়ানো ও ককটেল বিস্ফোরণ মামলায় সন্ধিগ্ধ আসামী হিসাবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ধানমন্ডি থানার মামলা নং- ১৬ (০৭) ২০২৪ জি. আর ১২১/২০২৪ ধারা-১৪৩/১৪৪/১৪৭/১৪৮/ ১৫০/ ১৫২/১৫৩/ ৩৩২/৩৩৩/৩৫৩ /৩০৭/৮২৭ /৪৩৫/৫০৬ /৩৪ পেনাল কোড ও তৎসহ ৩/৪/৬ ধারা বিস্ফোরক দ্রব্য আইন।

 

মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিব আমার জামিন আবেদন বাতিল করে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জর  করে ধানমন্ডি থানায় পাঠিয়ে দেয়। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেকটর (নিরস্ত্র) মোঃ মারুফ মেহেদী (৯৩২১২৩৮০৬১) আমাকে রিমান্ডে এনে আমার সাথে কোন অসৌজন্যমূলক আচরন করেনি, শুধুমাত্র আমার স্ত্রীকে ডেকে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে। এই মিথ্যা মামলাটি ধানমন্ডি থানায় দায়ের করে এস আই (নি:)- মোঃ কামরুল ইসলাম (বিপি-৭৬৯.৬০১৩৮৯৬)।

 

একদিন পরেই মামলাটি  anti-terrorism এ বদলী হয়। ২৩ জুলাই, ২০২৪ যখন আমি ধানমন্ডি থানায় রিমান্ডে, রাত প্রায় ১ টা, হঠাৎ ৭/৮ জন সজ্জিত অস্ত্রধারী ও হেলমেট পরিহিত পুলিশ সদস্য হাজতের সামনে এসে আমার নাম ধরে ডাকে, আমি সাড়া দিতে তারা আমাকে বের করে, দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে দুজন মিলে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে, বাকী পুলিশ সদস্যরা আমাদের অনুসরন করে। নিচ তলায় এসে দেখতে পাই কারফিউ এর মধ্যে লিমা ও আমার বড় বোনের মেয়ে চুমকী দাড়িয়ে আছে। আমি তাদের সাহস দেওয়ার জন্য ধমক দিয়ে বলি, ‘‘কারফিউ এর মধ্যে এত রাতে এখানে কি করছো, দ্রত বাসায় যাও’’। পুলিশ আমাকে একটি কাল রং এর মাইক্রোবাসে উঠায়, চির পরিচিত ঢাকা শহর আমার ভীষন ভিন্ন লাগতে শুরু করে। ফ্যাল ফ্যাল করে বাহিরে তাকিয়ে থাকি। দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে, আমার অনাগত ভবিষ্যতের জন্য নয়, নিরপরাধ দুজন অদম্য সাহসী মহিয়সী মহিলার সাথে খারাপ আচরনের জন্য। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারি আমাকে ডিবি অফিসে আনা হয়েছে। সেখানে আমাকে একটি খাঁচায় ঢুকানো হয়, ঐ একই খাঁচায় আমি, এ্যাডভোকেট ওবায়েদ ভাই ও উত্তরবঙ্গের একটি ছেলে ছিলাম। সারারাত নির্ঘুম কাটে, ফজরের আজান শুনতে পাই। ফজরের নামাজ আদায় করি। সকাল ৭টার দিকে পলিথিনে বাধা একটু ডাল ও দুটো রুটি খাঁচার মধ্যে আমাকে খেতে দেওয়া হয়। খাওয়ার চেষ্টা করি। সকাল ১১ টায় আমাকে খাচা থেকে বের করে হাতকড়া পরিয়ে দাড় করিয়ে রাখা হয়। মামলার পরবর্তী I.O এসএম রাইসুল ইসলাম, সিটিটিসি, ডিএমপি ঢাকা আমার সাথে অত্যন্ত সৌজন্যমূলক আচরন করেন এবং নির্ভয় প্রদান করে। পরে ডিবি অফিস চত্বরে নিয়ে একটি প্রিজন ভ্যানে ওঠানো হয়। প্রচন্ড গরমে প্রায় শতাধিক আসামীর মধ্যে দাড়িয়ে থেকে মনে হচ্ছিল মারা যাচ্ছি, কিছুক্ষন পরে প্রিজন ভ্যানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে ওঠানো হয় ও আদালতে আনা হয় । আদালতে আমার জামিন শুনানী করেন এ্যাড. ফয়সাল হাসান আরিফ ও এ্যাড. মিজানুর রহমান। আমি আইনজীবী বিধায় আমাকে কিছু বলতে বলা হয়। আমি আদালতে বলি, ‘‘আপনি বিচারক, বিচারকের আসন অত্যন্ত পবিত্র, আল্লাহ-ই বিচারের মালিক, আপনি দুনিয়ায় বসে বিচার করছেন, পবিত্রতম জায়গায় বসে অবিচার করবেন না, আপনি যদি ন্যায় বিচার না করেন, তবে আপনার সন্তানের নিকট আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে, কাল কিয়ামতের মাঠে জবাব দিতে হবে। চাকুরীর ভয় পাবেননা, আমাকে জামিন দিয়ে প্রমান করেন আপনি ন্যায় বিচার করতে পারেন, কারন FIR ও police forwarding -এ আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই ”। আরো অনেক কথা বললাম, কিন্তু  মো: তোফাজ্জল হোসেন, অতি: চীফ  মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা আমার জামিন আবেদন খারিজ করে আমাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। তখন বিচারককে বললাম, ’’ঠিক আছে স্বাধীন দেশে দেখা হবে’’ । বিস্ময়কর বিষয় হল, যে সকল পুলিশ ভাইয়েরা আমাকে আদালতে আনা নেওয়া করেছেন তারা সবাই বকশিস চাচ্ছে। আমি তো রিমান্ড থেকে আসছি, আমার কাছে কিছুই নেই। ঔষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে আমার পাশে যারা ছিল তাদেরকে বললাম ওদেরকে take care করার জন্য।

 

এরপর প্রিজন ভ্যানে আমাকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। কারাগারের গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাকে পাঠান হয় “আমদানী” নামক জায়গায়। বিশাল হলরুম প্রায় ৪/৫ শত কয়েদী। কারাগারে অনেকগুলি ভবন রয়েছে, এর একটি  “মেঘনা”। মেঘনার নীচতলায় এই  “আমদানীর’’ অবস্থান। আমার সাথে থাকা এ্যাডভোকেট ওবায়েদ ও আমি অসহায় অবস্থায় ঘুরাফেরা করছি। এর মধ্যে অল্প বয়সী একটি ছেলে এসে আমাদের বসার জন্য ও পরবর্তীতে রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করল। পরদিন সকালে আমাকে ও ওবায়েদ ভাইকে একই বিল্ডিং-এর তিন তলায় স্থানান্তর করা হল। আমার একটা কয়েদী নম্বর পড়ল, নাম্বারটি হল ২৯৯৬৮/২৪। আমি মেঘনা সেলের তৃতীয় তলার ২ নং সেলের বন্দী। এই সেলে মোট ৩৫ জন বন্দী রয়েছে। সবাই ঢাকার বিভিন্ন থানার নাশকতার মামলায় গ্রেফতার হয়ে এসেছে। আমাদের সেলে ২২ বছরের ছাত্র থেকে শুরু করে ৬৭ বৎসরের সিনিয়র সিটিজেন রয়েছে। রয়েছেন চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। মেঘনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে, এই কাম্পাসের মধ্যে একটা বেকারী আছে যেখানে পাউরুটি, চানাচুর, বিস্কিট, ড্রাইকেক সহ বিভিন্ন ধরনের টাটকা বেকারী আইটেম পাওয়া যায়। যদিও বেকারির সামনে হাজার হাজার মাছি ভনভন করতে থাকে সারাক্ষন। বাসায় কিংবা অফিসে একটা মাছি ঢুকলে তা তাড়ানোর জন্য কি প্রানপন প্রচেষ্টা। কিন্তু তখন হাজার হাজার মাছি দেখেও আমার কোন ঘৃণা হয়নি, মনে হয়েছে আমার মত এক একটা প্রাণী এবং ওরা অনেকটা স্বাধীন। ইচ্ছামত উড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ বলছেনা হাটাহাটি নিষেধ, যার যার সেলে ঢুকেন, আপনারা নাশকতার মামলায় এখানে এসেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে,  মেঘনার  সকল আসামীদের বের করে, শুধুমাত্র যাদের রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের এখানে রাখা হয়েছে। কারাগারের এই অংশকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে। এই ভবনের মূল ফটক সব সময় বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে মেঘনার কোন আসামী সাধারন কোন আসামীর সাথে দেখা করতে না পারে। প্রতিদিন সকল আসামীকে কারাগারের মাঠে হাটতে দেওয়া হয়। কিন্তু রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হওয়ার কারনে আমাদের সেই সুযোগ দেওয়া হত না। আমাদের  isolate করে মানসিক যন্ত্রণায় রেখে কষ্ট দেওয়া প্রশাসনের একটি অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। জেলের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, খাওয়ার একটি সংস্কৃতি আছে, আমাদের ভবনের বাইরে একটি দোকান আছে যাহা সকাল ৭টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে, যে কেউ cash বা PC তে টাকা থাকলে সেখান থেকে সদাই কিনতে পারেন, টয়লেট টিস্যু, সাবান, বিস্কুট, চা সহ প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এখানে পাওয়া যায়। ভবনের সামনে একটি আম কাঁঠাল ও মৌসুমী ফলের দোকান আছে, যে যার মত কিনছে। এই দোকানে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার কেনা যায়। রাতের তরকারি বিকেল ৫ টার আগেই ক্রয় করতে হয়, কেননা ৫ টায় সবাই লকারে যায়, প্রত্যেক সেলে একজন ইনচার্জ, একজন রাইটার ও একজন সেবক থাকে। ইনচার্জ সাধারনত বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে থাকে। আমাদের সেলের ইনচার্জ ছিলেন টিটো মিয়া, দীর্ঘ ১৮ বছর জেলে আছে, মার্ডার কেসে ৩১ বৎসর সাজার রায় হয়েছে। রাইটার ছিলেন ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক- মাসুম। রাজনৈতিক অস্থিরতার ঐ সময়টা ছিল গুজবের, কারন বন্দিরা জানতে পারেনা বাইরে কি হচ্ছে। এখানে কোন পত্রিকা আসেনা, টেলিভিশন কিংবা বাইরের সাথে যোগাযোগের কোন মাধ্যম নেই।

 

জেলখানায় সব প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ঘটনার স্বাক্ষী হচ্ছি। হাজতবাসের দ্বিতীয় দিন মো: মাসুদ রানা, বাড়ী নাটর-সাজাপ্রাপ্ত আসামী, কারাগারে কাজ করে, আমার পরিবারের দেওয়া কাপড় নিয়ে এসেছে। একটি লক্ষনীয় বিষয় হল এরা এসেই প্রথমে বলবে আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান, আমি কি আর বলব, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি এই বন্দির কৌশলি বক্তব্যের দিকে। আমি তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই কিন্তু পরে সে বলে আমার বকশিস দেন, ১০০ টাকা বের করে দেই, সে চলে যায়। এর পর আমার কাছে আসে শাকিল নামের আর এক Messenger, সেও এসে একই কথা, ততক্ষনে আমি এদের কৌশল বুঝতে পেরেছি দাবী তাদের ১০০ টাকাই। সে বলল নায়েক মজনুর মাধ্যমে আপনার কাছে টাকা পাঠানো হয়েছে। সে আমার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার ছেলের নাম জিজ্ঞাসা করে। টাকা দিয়ে, সে তার বকশিস দাবী করে। আমি তাকে ১০০ টাকার নোট ধরিয়ে দেই। সে চলে যায়, কিছুক্ষন পর সে আবার এসে আমাকে জানায় নায়েক মজনু ডাকছে, আমি গেলাম, যেয়ে বুঝতে পারলাম সে এ্যাডভোকেট সাব্বির হামজা চৌধুরী সোহাগ এর বিশেষ পরিচিত। তাই সোহাগের অনুরোধে সে আমার খোঁজখবর রাখছে।

 

জেলে ঘুম থেকে উঠতে হয় খুব ভোরে, সকাল ৫.৩০ টার আগেই। কারারক্ষী আসে গননা করতে, সবাইকে উঠে চারজন করে বসতে হয়। জেলের ভাষায় এটাকে বলা হয় “ফাইল”। ফাইল হচ্ছে অনেকটা আমাদের সময়ে স্কুলে স্যার আসার আগে সবাই যেমন টঠস্থ থাকতাম ঠিক সেই রকম। কারারক্ষী আসলে সুনসান নীরবতা, গণনা করে তারপর চলে যায়। কারারক্ষী অবশ্য প্রায়শঃ ইনচার্জ কে বিভিন্ন ভূল ধরে বকা-ঝকা করে তাদের ক্ষমতা দেখাতে ভুল করে না। কারাগারে আমাদের এই সেল ৪৫০ Sq.ft এর মত হবে। এই ঘরে আমরা মোট ৩৫ জন বন্দী ছিলাম। আমি সহ বন্দী এ্যাডভোকেট ওবায়দুল হক, হাজারীবাগ থানা থেকে জনাব মোঃ সোহেল আমীন, যিনি একজন ট্যানারী ব্যবসায়ী এবং তার ভাগ্নে আলতাফ যিনি হাজারীবাগে রাজীব লেদার স্টোরের মালিক, আমাদের সাথে একই সেলে ছিলেন। তারা দুজন সারাক্ষন আমাদের সেবা যত্ন করছেন। খাবার দাবার এগিয়ে দেওয়া, খাওয়া শেষে প্লেট ধোয়াসহ যাবতীয় কাজে আমাদের সহায়তা করছেন। বেশ সুঠাম দেহের এই মানুষ দুইটি যে আমাদের এভাবে সহযোগীতা করবে সেটা কখনও ভাবতে পারি নাই। কারাবন্দিদের সেবাই নিয়োজিত শাকিল এসেছে আমার প্রয়োজনীয় ঔষুধ নিয়ে, সাথে পরিবারের একটি চিঠি। সেপ্টেম্বর-এ কোর্ট বন্ধ থাকবে, তাই এই সময়টা আমাদের পেশাগত কাজে খুব ব্যস্ত  থাকতে হয়। আমাদের দেশের ওকালতি অনেকটা এক ব্যক্তি নির্ভর, কেননা ক্লায়েন্টরা ঐ ব্যক্তিকে দেখে মামলা দেয়, তাই তারা অন্য আইনজীবী সে যতই ভাল হোক, আস্থাহীনতায় ভোগে, সেক্ষেত্রে ঐ সময়টা ছিল অত্যন্ত pick time এবং কাজের বাইরে থাকা পেশার জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। আমি জেলে বসে সারাক্ষন চিন্তা করেছি আমার জামিনের আবেদন কিভাবে করছে, অবশ্য এ্যাডভোকেট রাজিয়া সুলতানা আসমানী সহ অন্যান্যরা খুব দক্ষতার সাথে পুরো বিষয়টি ম্যানেজ করতে পেরেছিল। ২৪/০৭/২০২৪ তারিখ আমার bail নামঞ্জরের সময় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট কারাবিধি অনুযায়ী চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।  কারা হসপিটালের ডাক্তার মাঝারি বয়সী ঝিনাইদহের, ভদ্রলোক খুব ভারী গলায় বললেন কি কি ঔষুধ খান, আমি বললাম। ডাক্তার সাহেব আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে আমাকে একটা prescription লিখে দেন, এর পর কারা ফার্মেসী থেকে আমাকে ৩ দিনের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। medical centre-এ হাবীব ভাইয়ের (সাতক্ষীরা) সাথে দেখা হয়, উনি মেয়ের কথা বলে কাদলেন, ড্রাইকেক ও কফি খাওয়ালেন। অসহায় এই মানুষটির আর্তনাদ আমাকেও কাঁদিয়েছে। এর পর দেখা পেলাম বাগেরহাট বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালামের সাথে। পরে বিল্লাল নামের এক যুবক যিনি কারা হাসপাতালে কাজ করেন, আমাকে কারা ল্যাবে নিয়ে যায়। সেখানে আমার ডায়েবেটিস টেস্ট করে তারা random sugar পায় ৬.৫। এখানে উল্লেখ্য যে কারাগারের অভ্যন্তরে যারা কাজ করে তারা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। মূলত বিডিআর বিদ্রোহে আটককৃতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার কাজ করে।

 

আমাদের সেলে মোট ৩৫ জন বন্দী রয়েছে। টিটু মিয়া ছাড়া সবাই রাজনৈতিক মামলার আসামী। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের এক ছাত্র আমাদের সাথে আছে, সে কখনো ভাত খায় না, শুধু পাউরুটি খেয়ে দিন পার করে, কারন পুলিশ তাকে তার মহাখালীর বাসা থেকে গ্রেফতারের সময় বলেছিল ’’তোকে জেলের ভাত খাওয়া” সে নাকি বলেছিল ”পারবেন না”। আমরা সকলে মিলে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তাকে ভাত খাওয়াতে পারিনি। কার্ড খেলা, গল্প গুজব করা ও ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাত করে আদায় করা, এই আমাদের কাজের পরিধি। আর আমি প্রতিদিন আসরের নামাজের পর সবাইকে নিয়ে inspiration speech দিতাম, চলত মাগরিব পর্যন্ত। ২৮ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যার পর আমরা যখন কারা সেলের মধ্যে বসে আছি তখন একজন কারারক্ষী এসে আমার ও এ্যাড. ওবায়েদ ভাইয়ের নাম ধরে ডাকল এবং বলল্, ”আপনাদের কাশিমপুর কারাগারে বদলী করা হয়েছে, সকাল ৫.৩০ মিনিটে প্রস্তুত থাকবেন, ডাকার সাথে সাথে বের হয়ে আসতে হবে, সময় দেওয়া হবেনা”। আমি প্রিজন ভ্যানের মধ্যে বেশীক্ষণ থাকতে পারিনা, দম বন্ধ হয়ে আসে, ভীষণ ভয় পাচ্ছি। সেদিন ছিল বুধবার, তাই কেরানীগঞ্জ থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর যেতে হয়তো ৪/৫ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। বেদনার ছাপ বাকী ৩৩ জন বন্দী সকলের। যাইহোক সবাই মিলে এশার নামাজ আদায় করলাম, নামাজে ইমামতি করতেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সমন্বয়ক, উনি সাধারনত মোনাজাত করতেন না। ঐদিন মোনাজাত করলেন; অনেক কাঁদলেন, মোনাজাতের ভাষা ছিল এরকম ’’হে আল্লাহ আর কত জুলুম অত্যাচার হলে, আমরা এই জালেম হাসিনার হাত থেকে মুক্তি পাব”। রাতে ঘুম হল না, ভোঁর পাঁচটা নাগাদ আমি ও ওবায়েদ ভাই জেলারের সাথে দেখা করতে সক্ষম হলাম। ওবায়েদ ভাইয়ের বয়স ৬৭, তাই তার কাশিমপুরের চালান বাতিল করে মেঘনার বৃদ্ধ  সেলে পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ”আমারও বয়স হয়েছে আমাকেও বৃদ্ধ সেলে পাঠিয়ে দিন” কি বুঝল জানিনা, তিনি আমাকেও বৃদ্ধ সেলে পাঠিয়ে দিলেন। যাইহোক কাশিমপুর যাওয়া থেকে পরিত্রান পেলাম। আমাদের অবশ্য মেঘনার বৃদ্ধ সেলে যেতে হয়নি, কারাগারের জমাদ্দারদের সহায়তায় পুরনো সেলে থেকেছি ৪ ঠা আগষ্ট রাত পর্যন্ত। ৪ ঠা আগষ্ট সন্ধ্যা ৭ টায় খবর আসে আমার ও এ্যাডভোকেট ওবায়েদ ভাইয়ের জামিন হয়েছে। সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট নাগাদ জেল গেটে আসি। সেখানে একজন ডেপুটি জেলার আমার নিকট আসে, বাড়ী যশোর, তিনি জানান অনিন্দ্য ইসলাম অমিত তার মাধ্যমে আমার খোজ-খবর রেখেছে। এখানে বিভিন্ন intelligence ageancy রয়েছে, তারা আমাকে পুনরায় গ্রেফতার করতে পারে, কিন্তু ডেপুটি জেলার সাহেব আমাকে সর্বাত্মক সহায়তা করলেন এবং অবশেষে রাত ৮টা নাগাদ জেল থেকে বের হই। জেল গেটে লিমা, চুমকী, মোবাশ্বের একটি এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছে। ডা: রাশেদুল বারী রাসেল এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছে। সারা ঢাকা শহর তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। প্রায় সকল রাস্তা বন্ধ, বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলছে প্রায় ৪ (চার) ঘন্টা সময় লেগেছে আমার ধানমন্ডি বাসায় আসতে। রাতে আর ঘুম হল না। পরদিন সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। এরপর আসল সেই মহেন্দ্রক্ষন, ৫ই আগস্ট, ২০২৪। প্রত্যক্ষ করলাম স্বৈরাচার হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার সেই শুভক্ষণ। ঢাকার রাজপথে নেমে এলাম, লাখো জনতা তখন ঢাকার রাজপথে,  জনতার সাথে মিশে গিয়ে উপভোগ করলাম স্বাধীনতার স্বাদ। এখন প্রত্যাশা জবাবদিহি মূলক গনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, আমার ও আপনার সন্তানদের জন্য, প্রতিজ্ঞা স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।

লেখক :

সিনিয়র এ্যাডভোকেট

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট

বিষয়